কলকাতা টাইমস নিউজ ডেস্ক :
পূর্ণা মজুমদার :
কথায় আছে, বাঙালির ১২ মাসে ১৩ পার্বন! কিন্তু সত্যিই কি সংখ্যাটা এখনো ১৩ – র ঘরেই দাঁড়িয়ে ?
নাকি কালক্রমে উৎসব প্রিয় বাঙালি তেরোর পিঠে এক যোগ করে রচনা করেছে, বাঙালির ১২ মাসে ১৪ পার্বন!
ওই শেষ পার্বণটি হল পাঠক প্রিয় উৎসব !
ওই শেষ পার্বণটি হলো লেখকের কলমে শোক – ক্ষোপ – দুঃখ – রাগ – আনন্দ প্রকাশের উৎসব !
” গড়ের মাঠ ইতিহাসের পাতা ” এই প্রবাদ ধরেই যদি পাতা উল্টানো যায় তাহলে দেখা যাবে, শুধুমাত্র কলকাতা নয় তথা সমগ্র ভারতে গভীর ঐতিহাসিক তাৎপর্য রেখে যায় এই গড়ের মাঠ ওরফে ময়দান। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম জনসমাবেশের মুখ্য জায়গা হিসেবে, নেতাজি,গান্ধীজী, নেহেরু সহ প্রমুখ নেতাদের রাজনৈতিক আলোচনাসভায় – মিছিলে বা সমাবেশে গড়ের মাঠ আজও ঐতিহাসিক পাতায় গাম্ভীর্য ধরে রেখেছে। কালক্রমে ফুটবল ক্রিকেট হোক বা জ্ঞানের চেতনা প্রতি পদে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ধারা বহন করে চলেছে। কালে কালে, ব্রিগেডের প্যারেড গ্রাউন্ড হয়ে ওঠে।
” ময়দান, মিলনক্ষেত্র “। প্রথমবারের জন্য কলকাতা বইমেলা অনুষ্ঠিত হয় ময়দানে।
আদতে, জার্মানির ফ্রাঙ্কফ্রুট বইমেলার অনুকরণেই গঠিত হয় কলকাতা বইমেলা। ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু হয় কলকাতা বইমেলার। কয়েকজন ব্যক্তির বিশেষ উদ্যোগে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এন. ধর অ্যান্ড সন্স প্রকাশন সংস্থার সত্ত্বাধিকারী বিমল ধর। তিনি ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের (এনবিটি) সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে অ্যাকাডেমি চত্বরে একটি ছোট আকারের বইমেলার আয়োজন করেন। এই বইমেলায় বাংলা বই বিক্রির অপ্রত্যাশিত সাফল্যে এনবিটি কলকাতার পাঠকদের বইয়ের প্রতি আগ্রহ সম্পর্কে ধারণা পায়। এরপরই শুরু হয় কলকাতায় একটি বার্ষিক বইমেলা আয়োজনের পরিকল্পনা।
ফলস্বরূপ, ১৯৭৬ সালে কলকাতা পুস্তক মেলা নামে একটি বইমেলার যাত্রা শুরু হয়। কলকাতা বইমেলা প্রথম শুরু হয় বেশ সাদামাটা আয়োজনে সে বছর বইমেলাটি কলকাতার ময়দানে আয়োজিত হয়নি। বরং, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল ও বিড়লা তারামণ্ডলের উল্টো দিকের একটি মাঠে (বর্তমানে মোহরকুঞ্জ উদ্যান) এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম বইমেলায় ৩৪টি প্রকাশনা সংস্থা এবং ৫৬টি স্টল অংশ নিয়েছিল। মেলা ৫ই মার্চ থেকে ১৪ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল ।
সেই সময়ের স্বল্প পরিসরের ছিমছাম বইমেলা পাঠক এবং সাধারণ মানুষদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিলো। পরবর্তীতে বইমেলার আয়তন আরও বড় হতে থাকে এবং পরে ময়দানে স্থানান্তরিত হয় যদিও সঠিক বছর জানা যায়না। কালক্রমে কলকাতা বইমেলা ১৯৮৩ সালে আন্তর্জাতিক বইমেলার স্বীকৃতি লাভ করে। মেলাটি মূলত “পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড” কর্তৃক আয়োজিত হয়। একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বইমেলায় পরিণত হয়েছে। বর্তমানে এই মেলা এশিয়ার তথা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বইমেলা হিসেবে পরিচিত।
সাল ১৯৯১আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় থিম কান্ট্রি বা ফোকাল থিম প্রথার সূত্রপাত। এই ধারণার জন্ম হয় জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার গেস্ট অফ অনার ধারণার অনুকরণে। আন্তর্জাতিক স্তরে কলকাতা বইমেলার গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করার উদ্দেশ্য নিয়ে থিম দেশ নির্বাচন করা শুরু। বলাবাহুল্য, প্রতিবছর থিম কান্ট্রির পরিবর্তন বিশেষভাবে নজর কাড়ে।
কখনো ফোকাল থিমে কোনো দেশ বা কোনো রাজ্য কখনো বা কোনো বিশেষ বিষয়ের দেখা মেলে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ সালে ভারত ফোকাল থিম ছিল। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গ (১৯৯৫) এবং বাংলাদেশ (১৯৯৯ ও ২০২২) দুইবার করে ফোকাল থিমে নির্বাচিত ছিলো । কলকাতা বইমেলার ইতিহাসে এই থিম কান্ট্রি প্রথা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়। একই সাথে, এটি আন্তর্জাতিক স্তরে বইমেলার পরিচিতি ও গুরুত্ব বৃদ্ধিতে অত্যন্ত সহায়ক। অন্যদিকে, গতবছরে বইমেলার থিমে দেখা গেছিলো ব্রিটেন, আর এবছরে ৪৮ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার থিম কান্ট্রি হিসেবে প্রথম বারের মত দেখা মিলল জার্মানের।
বলাবাহুল্য, কয়েক বছর ধরেই বর্তমানে বৃহত্তর পরিসর এবং দর্শকদের জন্য অনন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে বইমেলাটি সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে বইমেলা প্রাঙ্গনে আয়োজন করা হয়।
“বাঙালির রক্তে বইয়ের নেশা” পায়ে পায়ে ৪৮ বছরে এলো সেই স্বল্প পরিসরে, সাদাকালো অক্ষরের বই আর সাদামাটা আয়োজনের বইমেলা। আজকে বলার অপেক্ষা রাখে না, নানান দিকে পৃথক মহিমায় স্বগর্বে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা নিজে নাম খোদাই করেছে স্বর্ণাক্ষরে।
জানুয়ারি মাসের শেষের সপ্তাহে বুধবার করে আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডারের অনুসরণে কলকাতায় যে বইমেলা শুরু হয় তা পাঠক মহলকে লেখকের কাছে আসার সুযোগ করে দেয়। কলকাতা বইমেলা কেবলই বই কেনা – বেচার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরঞ্চ, জাতি – ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মিলনক্ষেত্র এবং সার্বিক জ্ঞান আদান -প্রদানের অন্যত্তম আকর হয়ে ওঠে। এবারেও সেই প্রথার একেবারেই অন্যথা হতে দেখা গেল না। ১২দিনের বইমেলাকে কেন্দ্র করে, নানান দেশ – বিদেশের বই বাংলা – ইংরেজি সহ অনন্য ভাষার বইয়ের প্রাচুর্য। এবারে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে অনুপস্থিত ছিলো প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের স্টল যদিও সে বিষয়ে আমল দিতে নারাজ বই প্রেমীরা কারণও স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে এক ঝাঁক তারকা, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার থেকে শুরু করে চিত্রকর সহ নানান বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের উজ্জল সমাবেশে সমৃদ্ধ হল বইমেলা প্রাঙ্গন ।
সেমিনার থেকে ওয়ার্কশপ, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হোক বা সুবর্ণজয়ন্তীর উৎযাপন । চিত্রকরেরে তুলির টানে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ফুটিয়ে তোলা অথবা প্রথমবারের জন্য নবপ্রজন্মের লেখক-লেখিকাদের কলম ধরার স্বাধীনতা অন্যদিকে, বইমেলায় পরিবেশিত মনমুগ্ধকর নাচ বা গানের অনুষ্ঠান প্রভৃতি সকল অনুভূতিকেই বইমেলা যেন তার নিজের সিন্ধুকে যত্নে গুছিয়ে রাখলো।
সকলের সঙ্গে এবারে আমিও ঘুরে দেখেছিলাম বইমেলা। নতুন নতুন জীবন্ত কতো ছবি চোখের সামনে! মেলায় চলতে অনুভব করলাম, এই বই মেলাটাই যেন একটা বিশালকার আস্ত বই। প্রতি মোড় যেন বইয়ের একক পৃষ্ঠা।
যত পা চলছি নতুন এক একটি করে গল্প বেরিয়ে আসছে জানেন!
শরীর বা মস্তিষ্ক কোনটাই দিচ্ছে না স্বাভাবিকভাবে বইমেলা উপভোগ করার অধিকার, তবুও বাবার মানসিক বলে হুইলচেয়ারে তরুণী এলো বইমেলা ভ্রমণে।
বহু বছর পর পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে যখন দেখা চুলে পাক ধরেছে দুজনেরই, তাও বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট।
নাতনির হাত ধরে দিদার কলকাতা বই মেলা ভ্রমণ পায়ে জোড় নেই তেমন তবু নাতনির হাতেই যেন ভীষণ ভরসা।
এতদিন আমাদের কাছে সুপরিচিতি পেয়েছেন এমন অনেক বিশিষ্ট ডাক্তার পরবর্তীতে লেখক হিসেবে। আমাদের কাছে স্বনামধন্য গায়ক বা প্রখ্যাত অভিনেতা – অভিনেত্রীও লেখক হিসেবে দ্বিতীয় পরিচিতি পেয়েছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে এবছরের কলকাতা বইমেলায় আলাপ হলো এমন এক ব্যক্তির যিনি আদতে, মুদি বিক্রেতা। মুদিখানার দোকান নিত্য রুজি – রোজগার। বলাবাহুল্য পারিবারিক অভ্যাসে পাওয়া, শৈশব থেকে বই পড়ার আগ্রহ । মৌখিক গল্প করতে করতে সাবলীল ভাষায় বলিষ্ঠ সামাজিক গল্প লেখার নেশা। তাঁকে এনে দিয়েছে লেখক হিসেবে সামাজিক সম্মান। এ বছরের বইমেলায় “অনুরাগ প্রকাশনীতে” গিয়ে হটাৎই চোখে পড়ল “এসো গল্প শুনি ” নামক একটি বই লেখক সলিল চক্রবর্তীর লেখা। শেষ দিনের বই মেলায় লেখক নিজেও উপস্থিত ছিলেন । লেখকের থেকে জানতে পারলাম, ২০২২ সালের শেষের দিকে দুর্গানগর, কলকাতার “জনমণ প্রকাশনীর” হাত ধরে লেখক এর প্রথম বই “রামধনু” প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে “তিস্তা পাড়ের রহস্য” – র মতন বই প্রকাশিত হয় যা পাঠককুলের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। অন্যদিকে “রিপু”, “অহংকার”, “নববর্ষ”, “অন্তিম প্রস্তানের” মত কবিতাও তাঁর লেখনী পাওয়া যাবে এবারে প্রকাশিত “এসো গল্প শুনি ” বইটির মধ্যেই। পশ্চিমবঙ্গে ভিন্ন জায়গায় প্রায় ১৫০টি লাইব্রেরির মধ্যে লেখক এর লেখা বই পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশেও ইতিমধ্যেই লেখকের লেখা গল্প জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর লেখা ” স্বর্গ দর্শন ” নামক গল্পের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে নাটক তৈরি হচ্ছে। বলাবাহুল্য বাংলা সাহিত্য একাডেমির দ্বারা এক সাহিত্য প্রতিযোগিতা ২০২৫ এর জন্য লেখকের প্রথম বই ” রামধনু ” মনোনীত হয়েছে।
“যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।”
এই বাংলা প্রবাদেরই যেন বাস্তব রূপ আমাদের সমাজের নানা স্তরে থাকা এমন রোজকার সলিল বাবুরা।
প্রেমিক প্রেমিকার এক প্লেটে খাবার ভাগ বা প্রেমিকের ভরসায় একটু বেশী হলেও বইমেলায় আরো দুই পা চলা ।বইয়ের স্টলে স্টলে ঘোরা আর বই দেখা, এই বই না সেই বই,সেই নিয়ে তুমুল একটা জটিল আলোচনা বন্ধুদের গ্রুপে। এই বইমেলায় প্রেমের শুরু বিয়ের বয়স ৫০ বছর ছুঁই ছুঁই । বৃদ্ধ দম্পতি বইমেলায় অবসর জীবন কাটাতে আবারো বইয়ের খোঁজে।বইমেলা এমনই নানান গল্প প্রতি বাঁকে বাঁকে রেখে যায়। বইমেলায়এই বারোটা দিন নামিদামি খাবারের ব্যান্ডের পাশাপাশি অনেকের ফুচকা, ঝাল মুড়ি বা হারাতে বসা চটের ব্যাগ, কাঠের চিরুনি বা পোড়া মাটির হাতে গড়া গয়না বেঁচে ঘরে কিছু টাকা নিয়ে যাওয়ার আশা।
এই বইমেলা কোন এক সত্তর ঊর্ধ অজানা কবির সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে মাত্র ১০ টাকার বিনিময় অমূল্য জ্ঞান বিলোনোর উৎসব।
সময় যতো যাচ্ছে আমরা ধীরে ধীরে ডিজিটাল যুগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি সেখানে দাঁড়িয়ে ২০২৫ সালে, ৪৮ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় প্রায় ২৭ লক্ষ্য টাকার বইয়ের ব্যাবসা। আমরা এখনো……”বই বাঙালির আত্মার খোরাক “।