কলকাতা টাইমস নিউজ ডেস্ক :
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সম্প্রতি কলকাতায় দুই দিনের সফরে এসে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। তার এই সফর মূলত পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান তৎপরতা এবং ছত্তিশগড়ে মাওবাদী দমন অভিযানকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয়েছিল। সম্প্রতি দেশের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মদির মার্কিন সফর এবং পার্ষবর্তী দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থির অবস্তার সমাধান লক্ষে এই সফর কি না তাই নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন ছিল কিন্তু সেই ভাবনা চিন্তার অবসন ঘটিয়ে জানা যায়ডোভালের এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ,এমনটাই অন্তত মনে করছেন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞরা।
সূত্রের খবর, গত এক মাসে আইএসআই-এর একটি প্রতিনিধি দল দুইবার বাংলাদেশ সফর করেছে। এর পাশাপাশি, ছত্তিশগড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক মাওবাদী দমন অভিযানের পর মাওবাদী নেতাদের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
অন্যদিকে গোয়েন্দা সূত্রের খবর, গত তিন মাসে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমে বাংলাদেশভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আনসার-আল-ইসলাম (Ansarullah Bangla Team – ABT) এবং পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-এ-মোহাম্মদের (JeM) মোট ১৯ জন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বশেষ, ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে চেন্নাই থেকে অসম পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স (STF) এক প্রধান এ.বি.টি সদস্যকে গ্রেফতার করে।
ডোভাল তার বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত মাসেই আইএসআই-এর একটি ১০ সদস্যের দল চট্টগ্রামে এক সপ্তাহ ধরে ক্যাম্প করেছিল। এর আগে বহুবার পশ্চিমবঙ্গকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশের প্রধান রুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পাসাপসী মাওবাদীদের উপস্থিতি নিয়ে নতুন শঙ্কা পশ্চিমবঙ্গে একসময় মাওবাদীদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল, বিশেষ করে ২০১১ সালে সিপিআই(মাওবাদী) নেতা কিষেণজির মৃত্যু পর্যন্ত। তবে সাম্প্রতিককালে ছত্তিশগড়ে চালানো অভিযান ও নিরাপত্তা বাহিনীর লাগাতার তৎপরতার কারণে ফের পশ্চিমবঙ্গে কিছু মাওবাদী নেতা আশ্রয় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে—পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে এখনও মাওবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী প্রচুর সমর্থক রয়েছে। ডোভাল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন, এসব এলাকায় নজরদারি আরও কঠোর করতে হবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
সূত্রের খবর, সম্প্রতি ছত্তিশগড়ের বাস্তার অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে নিহত ৩১ জন মাওবাদীর মধ্যে একজন, হুঙ্গা কর্মা, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ছিল এবং এখানে সংগঠন পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছিল।
গোয়েন্দা সূত্র অনুসারে, বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনী বেশ কয়েকজন শীর্ষ মাওবাদী নেতার সন্ধানে রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন:
• মল্লোজুলা ভেনুগোপাল রাও ওরফে সোনু
• থিপ্পিরি তিরুপথি ওরফে দেবজি
• নিরমলা
• মাদভি হিডমা
• কাটাকাম সুদর্শন
এদের প্রত্যেকের মাথার দাম ১ কোটি টাকা ঘোষণা করা হয়েছে।
২০২৪ সালে ছত্তিশগড়ে নিরাপত্তা বাহিনী ২১৯ জন মাওবাদীকে হত্যা করেছে, যার মধ্যে ৮১ জনকে এ বছরই হত্যা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে ভারতে মাওবাদী সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল করা হবে।
অজিত ডোভালের এই সফর পশ্চিমবঙ্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে, বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী জঙ্গিদের রুখতে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে মাওবাদী প্রভাব নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রের মতে, পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এটি বহুদিন ধরেই মাওবাদী ও জঙ্গিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তাই ভবিষ্যতে নিরাপত্তা আরও কঠোর করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ডোভালের এই সফরের পর পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় রেখে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি আরও কঠোর করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। সীমান্ত এলাকা দিয়ে জঙ্গিদের প্রবেশ, মাওবাদীদের গোপন কার্যকলাপ এবং বিদেশি গুপ্তচর সংস্থার তৎপরতা রোধ করতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডোভালের এই সফর স্পষ্টতই দেখিয়ে দিল, কেন্দ্র সরকার এখন এই বিষয়গুলোকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং ভবিষ্যতে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।