spot_img
35.7 C
Kolkata
Friday, June 13, 2025
spot_img

ঐতিহ্যবাহী শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের দায়িত্ব এখন মহিলাদের হাতে, গর্বের নজির গড়ল বাংলা !

কলকাতা টাইমস নিউজ ডেস্ক :

শিলিগুড়ি: আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী শক্তির উদাহরণ দিতে গেলে আমাদের চারপাশে এমন অনেক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যাঁদের কথা বলতে গেলে শব্দ কম পড়ে যায়। তেমনই এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ঐতিহ্যবাহী শিলিগুড়ি টাউন রেলওয়ে স্টেশন। যেখানে রেল স্টেশনের প্রায় সমস্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন শুধুমাত্র মহিলা কর্মীরা। হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষ ছাড়া এই স্টেশনের যাবতীয় কাজ এখন পরিচালনা করছেন মহিলা কর্মীরাই। স্টেশন ম্যানেজার থেকে পোর্টার, পয়েন্টসম্যান থেকে গেটকিপার — সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের ছাপিয়ে মেয়েরাই নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন প্রতিদিন।

ঐতিহ্যবাহী শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন মানেই বাঙালির আবেগ। কারণ এই স্টেশনে পদধূলি পড়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মনীষীদের। আর আজ সেই ঐতিহাসিক স্টেশনের রাশ রয়েছে নারীদের হাতে। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের অধীনে থাকা এই স্টেশনটি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মহিলা পরিচালিত রেলওয়ে স্টেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি গোটা ভারতবর্ষে এমন মহিলা পরিচালিত স্টেশনের সংখ্যা মাত্র চারটি। ফলে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন আজ নারীদের অদম্য মানসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

৩৬৫ দিন নিরবিচারে কাজ সামলাচ্ছেন মহিলা কর্মীরা

এই স্টেশনে কর্মরত রয়েছেন মোট ৩০ জন মহিলা কর্মী। স্টেশন ম্যানেজার প্রতিমা দে সহ তিনজন পয়েন্টসম্যান, দুইজন মহিলা পোর্টার, চারজন গেটকিপার, চারজন জুনিয়র কমার্শিয়াল ক্লার্ক এবং ১১ জন মাল্টিস্কিলড স্টাফ রয়েছেন, যাঁরা সমস্ত কাজ একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলাচ্ছেন। পুরুষ কর্মীর সংখ্যা হাতে গোনা মাত্র দু’একজন হলেও, ট্রেন পরিচালনা থেকে শুরু করে প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবটাই নির্ভর করছে মহিলা কর্মীদের দক্ষতার উপর। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, সকাল থেকে রাত — ৩৬৫ দিন অনায়াসে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন ম্যানেজার প্রতিমা দে বলেন, “এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশনে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমরা গর্বিত। আমাদের উপর যে বিশ্বাস রাখা হয়েছে, আমরা সেটাকে সম্মানের সঙ্গে রক্ষা করছি।” মাল্টিস্কিলড স্টাফ অনিন্দিতা দাস বলেন, “আগে মেয়েরা শুধুমাত্র ঘরের কাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। মহিলারাও দেশের সীমান্ত পাহারা দিচ্ছেন, প্লেন চালাচ্ছেন, ট্রেন পরিচালনা করছেন। আমরা গর্বিত যে আমরা এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশনের দায়িত্ব সামলাচ্ছি।”

মহিলা পোর্টারদের আত্মবিশ্বাস নজরকাড়া

যে কাজগুলো এতদিন কেবলমাত্র পুরুষদের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেই কাজও আজ অনায়াসে সামলাচ্ছেন মহিলা কর্মীরা। স্টেশনে কাজ করা দুইজন মহিলা পোর্টার সুলেখা দেবী এবং অনিন্দিতা দাস প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত সমানতালে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাজ হল যাত্রীদের লাগেজ টেনে নিয়ে যাওয়া, প্ল্যাটফর্মে মাল উঠানো-নামানো, এবং অন্যান্য পোর্টারদের কাজ। সাধারণত এই ধরনের কাজ করতে পুরুষদেরই দেখা যায়, কিন্তু সুলেখা দেবী এবং অনিন্দিতা দেবী প্রমাণ করেছেন যে, ইচ্ছে থাকলে মেয়েরা সবকিছুই করতে পারে।

সুলেখা দেবী বলেন, “কাজ করতে গিয়ে আমরা কখনও ভাবিনি যে আমরা মহিলা। আমাদের হাতে যেমন ভারী লাগেজ থাকে, তেমনি যাত্রীদের সেবাও করতে হয়। কাজ করতে করতে আমরা বুঝেছি, শরীরের জোর নয় — মানসিক শক্তিই আসল।”

ট্রেন পরিচালনা থেকে সিগন্যাল অপারেশন, সবই নারীদের হাতে

এই স্টেশনে ট্রেনের সিগন্যাল অপারেশন, লগবুক মেইনটেন করা, ট্রেন আসা-যাওয়ার সময়সূচী নির্ধারণ করা, অপারেশন কন্ট্রোল — সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ মহিলারাই করে থাকেন। দিনরাত এক করে ট্রেনের চলাচল ঠিক রাখার গুরুদায়িত্ব তাঁদের উপর বর্তায়। প্ল্যাটফর্মের যাত্রী নিরাপত্তা বজায় রাখা থেকে শুরু করে, নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ এবং প্রস্থান করানো — সবই আজ করছেন মহিলারা।

গেটকিপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন চারজন মহিলা, যাঁদের মধ্যে দুজন নিয়মিত লেভেল ক্রসিংয়ে দায়িত্ব পালন করেন। মাল্টিস্কিলড স্টাফ হিসেবে কাজ করা ১১ জন মহিলা একাধিক কাজ সামলান, যেমন — টিকিট বিক্রি, লগবুক রেকর্ড, ট্রেন সিগন্যাল অপারেশন, প্ল্যাটফর্ম নিরাপত্তা ইত্যাদি। প্রতিদিনের ট্রেন শিডিউল মেইনটেন করতে গিয়ে তাঁদের সময়ের কোনও ছন্দপতন হয় না।

বিরল দৃষ্টান্ত গড়ল শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন

শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনকে সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত স্টেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১৮ সালে। এরপর ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় যে, এই স্টেশনটি সম্পূর্ণরূপে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হবে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোনওরকম সমস্যা ছাড়াই নিরবিচারে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মহিলা কর্মীরা।

সম্প্রতি কাটিহার রেলওয়ে ডিভিশনের ডিআরএম এস কে চৌধুরী এবং এডিআরএম এস চিলাওয়ারোয়ার স্টেশনটি পরিদর্শন করে এর আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মতে, “শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনকে আরও আধুনিক করার জন্য পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। মহিলাদের দক্ষতা এবং সাহস দেখে আমরা অত্যন্ত গর্বিত।”

পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু এখন এই স্টেশন

এখন শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন শুধু রেল পরিষেবার জন্যই নয়, পর্যটকদের কাছেও অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত পর্যটকরা অবাক হন এই দেখে যে, একটি পুরো স্টেশন শুধুমাত্র মহিলা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ এবং প্রস্থান মুখে বসানো হয়েছে আটটি সিসিটিভি ক্যামেরা, যাতে নিরাপত্তার কোনো ফাঁক না থাকে।

একজন পর্যটক বলেন, “এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। এত বড় স্টেশন সম্পূর্ণভাবে মহিলারা চালাচ্ছেন, এটা ভাবাই যায় না। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের গর্ব।”

 নারী শক্তির প্রকৃত উদাহরণ শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন

একসময় নারীদের শুধুমাত্র গৃহস্থালির কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার প্রবণতা ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণা বদলে গেছে। আজ মহিলারা সীমান্ত রক্ষা করছেন, উড়োজাহাজ চালাচ্ছেন, ট্রেন পরিচালনা করছেন এবং রেলস্টেশনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন। শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন তার উজ্জ্বলতম প্রমাণ।

আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনের এই অদম্য মহিলা বাহিনীর কথা জানলে যে কোনও মানুষ গর্ব অনুভব করবেন। একবিংশ শতাব্দীর ভারতবর্ষে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সমতার পথে এগিয়ে চলার পথে শিলিগুড়ি টাউন স্টেশন একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কারণ তারা প্রমাণ করেছেন — “আমরাও পারি, আমরাও গড়তে পারি।”

Related Articles

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
22,400SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles

Enable Notifications Thank You No thanks