কলকাতা টাইমস নিউজ ডেস্ক :
গত ২৯শে মার্চ, শনিবার, কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হলো সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন এবং বার্ষিক সমাবর্তন উৎসব। প্রায় পাঁচ দশক ধরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান, যা বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরেও সমাদৃত।
পরিষদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও অবদান
১৯৭৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি কিছু সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তির প্রচেষ্টায় কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদ। এটি মূলত ভারতীয় সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও অন্যান্য পারফর্মিং আর্টসের প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে পরিষদের ছয় লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী এবং ৬০০০-রও বেশি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিশ্বের ১৫টিরও বেশি দেশে এই সংগঠন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করছে।
এই প্রতিষ্ঠানের বিকাশের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন সদ্যপ্রয়াত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও সংগঠক কাজল সেনগুপ্ত। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এই সংগঠন শুধু সাংস্কৃতিক বিকাশই নয়, বহু মানুষের জীবিকা নির্বাহের সুযোগ তৈরি করেছে। গান, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, তবলা, যোগাসন সহ নানা কলাশিল্পে পারদর্শীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত করেছে পরিষদ।
সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের বিশেষ আয়োজন
পরিষদের ৫০ বছর পূর্তির বিশেষ উৎসব উপলক্ষে এবছর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে। দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলা এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন এডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অধ্যাপক সমিত রায়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ভাস্কর গুপ্ত এবং এডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য সুরঞ্জন দাস।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেত্রী মিতা চ্যাটার্জী, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী অমিতা দত্ত, প্রখ্যাত চিত্রকর সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় সহ অন্যান্য গুণীজন। এই বছর ‘কলামনি পুরস্কার’ প্রদান করা হয় খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী যোগেন চৌধুরী, সংগীতশিল্পী ইন্দ্রাণী সেন ও তবলাবাদক বিক্রম ঘোষকে। এছাড়া, কাজল সেনগুপ্ত মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পান বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী স্বাগতালক্ষ্মী দাসগুপ্ত।
সমাবর্তন ও বিশেষ সম্মাননা প্রদান
এই বছর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রায় তিন হাজার ছাত্রছাত্রীকে ‘বিশারদ’ (৫ম বর্ষ) ও ‘রত্ন’ (৭ম বর্ষ) ডিপ্লোমা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি, দীর্ঘ ২০ বছর বা তার বেশি সময় ধরে পরিষদের সাথে যুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের ‘লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’-এ সম্মানিত করা হয়। এই বিশেষ সম্মাননা পান প্রায় তিনশো জন শিক্ষক ও শিক্ষিকা।
উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ ছিল ১০০০ সমবেত কণ্ঠে সংগীত পরিবেশনা, ৫০০ জনের সমবেত আবৃত্তি এবং প্রায় ৮০০ নৃত্যশিল্পীর সম্মিলিত পরিবেশনা। এছাড়া, অনুষ্ঠানে উপস্থিত ৫০০ জন চিত্রশিল্পী পেন্সিল স্কেচের মাধ্যমে অনুষ্ঠান চিত্রায়িত করেন।
সংস্কৃতি প্রসারের নিরলস প্রচেষ্টা
পরিষদ শুধু একটি পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা নয়, বরং এটি শিল্পীদের যথাযথ সম্মান ও প্ল্যাটফর্ম দেওয়ার লক্ষ্যে সারা বছর ধরে অনুষ্ঠান, চিত্রপ্রদর্শনী এবং কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। এই সাংস্কৃতিক যাত্রা পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু হয়ে আজ আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছেছে।
সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কেন্দ্র সরকার স্বীকৃত পরিষদের মুখপত্র ‘সংস্কৃতি বিচিত্রা’-র ডিজিটাল সংস্করণের উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া, সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে বিশেষ ডাকটিকিট এবং বেশ কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
সম্মানিত সম্পাদক ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পরিষদের সম্পাদক ড. শান্তনু সেনগুপ্ত এই সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের পরিকল্পনা ও পরিচালনার মূল কারিগর ছিলেন। তিনি জানান, ভবিষ্যতে পরিষদ আরও বৃহৎ পরিসরে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রসারে কাজ করবে এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় শিল্পকলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
এই উৎসব ও সমাবর্তন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিস্মরণীয় মিলনোৎসব হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।