কলকাতা টাইমস নিউজ ডেস্ক :
দেবজিৎ গাঙ্গুলী
ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাম্প্রতিক ‘অপারেশন সিন্দুর’ রাতারাতি খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে। পাকিস্তানের কোতলি, মুরিদকে এবং বাহাওয়ালপুরে জঙ্গি ঘাঁটিগুলিতে নিশানা করে চালানো হয়েছে এই হামলা। পাকিস্তান স্বীকার করেছে যে, অন্তত নয়টি স্থানে আঘাত হেনেছে ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই হামলার পেছনে বাহাওয়ালপুর কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল?
পাকিস্তানের ১২তম বৃহত্তম শহর বাহাওয়ালপুর কেবল একটি শহর নয়, বরং এটি জইশ-ই-মহম্মদ (জেইএম)-এর প্রধান ঘাঁটি। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মাসুদ আজহার এই শহরেই জন্মেছেন এবং এখানেই তার বাসভবন। এখানেই রয়েছে সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র—জামিয়া মসজিদ সুবহান আল্লাহ, যাকে ‘উসমান-ও-আলি’ ক্যাম্পাস নামেও ডাকা হয়।
এই ১৮ একর জমিতে বিস্তৃত ক্যাম্পাস শুধু একটি মাদ্রাসা নয়, বরং এটি একটি পুরো প্রশিক্ষণ ও প্রোপাগান্ডা কেন্দ্র—যেখানে জঙ্গি নিয়োগ, অর্থসংগ্রহ ও মতাদর্শগত মগজধোলাই চলে দীর্ঘদিন ধরে। ভারতীয় বাহিনী এই স্থাপনাকে ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর মূল লক্ষ্যগুলির একটি হিসেবে বেছে নেয়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, জামিয়া মসজিদের ভেতরে রয়েছে ৬০০ ছাত্রের আবাসন, একটি সুইমিং পুল, ঘোড়ার আস্তাবল এবং একটি জিম। এইসব অবকাঠামোই প্রমাণ করে, এটি কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জঙ্গি প্রস্তুত কেন্দ্র, যা চালিত হয় আল-রহমত ট্রাস্ট নামে একটি ছদ্ম সংস্থার মাধ্যমে—যা আসলে জেইএম-এর অর্থনৈতিক শাখা।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য হলো, এই জেইএম ক্যাম্পটি পাকিস্তানের ৩১ কর্পসের সদর দফতরের খুব কাছেই অবস্থিত। এটি প্রশ্ন তোলে—পাক সেনা বা আইএসআই কি এই জঙ্গি সংগঠনকে আশ্রয় দিচ্ছে? আন্তর্জাতিক মহল বরাবরই অভিযোগ করে এসেছে, পাকিস্তান গোপনে এই ধরনের গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিয়ে আসছে।
১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর, ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করে কাবুলে নিয়ে যাওয়া হয়। যাত্রীদের মুক্তির বিনিময়ে ভারত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তিন কুখ্যাত জঙ্গিকে, যাঁদের একজন ছিলেন মাসুদ আজহার। মুক্তির কিছুদিনের মধ্যেই তিনি গঠন করেন জইশ-ই-মহম্মদ—একটি সুপরিকল্পিত এবং সংগঠিত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, যার উদ্দেশ্য কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা।
সন্ত্রাসের ইতিহাস: ভারতীয় ভূখণ্ডে জেইএম-এর রক্তাক্ত ছায়া
- অক্টোবর ২০০১: জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভায় আত্মঘাতী হামলা, নিহত ৩০ জন।
- ডিসেম্বর ২০০১: ভারতের সংসদে হামলা, নিহত ১৪ জন।
- জানুয়ারি ২০১৬: পাঠানকোট বিমানঘাঁটিতে হামলা।
- সেপ্টেম্বর ২০১৬: উরি সেনা ঘাঁটিতে হামলা, শহিদ ১৯ সেনা।
- ফেব্রুয়ারি ২০১৯: পুলওয়ামা আত্মঘাতী হামলা, নিহত ৪০ সিআরপিএফ জওয়ান।
এই হামলাগুলির প্রতিটিতেই জেইএম-এর নাম উঠে এসেছে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারত বালাকোটে বায়ু হামলা চালায়।
🧨 জইশ–ই–মহম্মদ (জেইএম)-এর বড় হামলার তালিকা
📍 এপ্রিল ২০০০
🔸 স্থল: বাদামি বাগ, শ্রীনগর
🔸 ঘটনা: প্রথম আত্মঘাতী হামলা—১৭ বছরের আফাক শাহ ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে গাড়ি বিস্ফোরণ ঘটায়
🔸 নিহত: ৪ জন সেনা
📍 অক্টোবর ২০০১
🔸 স্থল: জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভা, শ্রীনগর
🔸 ঘটনা: আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ
🔸 নিহত: ৩০+ জন
📍 ডিসেম্বর ২০০১
🔸 স্থল: ভারতীয় সংসদ ভবন, নয়াদিল্লি
🔸 ঘটনা: লস্কর-ই-তইবার সঙ্গে যৌথ হামলা
🔸 নিহত: ১৪ জন (৮ জন নিরাপত্তা রক্ষীসহ)
📍 জানুয়ারি ২০১৬
🔸 স্থল: পাঠানকোট বিমানঘাঁটি, পাঞ্জাব
🔸 ঘটনা: জেইএম জঙ্গিদের হামলা
🔸 নিহত: ৩ জন নিরাপত্তা কর্মী
📍 সেপ্টেম্বর ২০১৬
🔸 স্থল: উরি সেনা ব্রিগেড, কাশ্মীর
🔸 ঘটনা: ভোররাতে সশস্ত্র হামলা
🔸 নিহত: ১৯ জন ভারতীয় সেনা
📍 ফেব্রুয়ারি ২০১৯
🔸 স্থল: পুলওয়ামা, জম্মু ও কাশ্মীর
🔸 ঘটনা: আত্মঘাতী গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ
🔸 নিহত: ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান
📍 মার্চ ২০২৫ (সম্ভাব্য)
🔸 স্থল: পহেলগাম
🔸 ঘটনা: জেইএম-এর সহায়তাপ্রাপ্ত একটি গোষ্ঠীর হামলা
🔸 নিহত: ৯ জন পর্যটক এবং নিরাপত্তা রক্ষী
জেইএম বর্তমানে বিভিন্ন নামে (যেমন “কাশ্মীর টাইগার্স”, “কাশ্মীর ফ্রিডম আর্মি”) ছদ্মবেশে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যায়।
অন্যদিকে শোনা যায়, বাহাওয়ালপুর শহরে একটি গোপন পারমাণবিক কেন্দ্রও রয়েছে। এই তথ্যের সত্যতা যাচাই করা কঠিন হলেও, শহরটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
প্রশ্ন উঠছে—এই শহর কি শুধুই একটি ভূখণ্ড, নাকি পাকিস্তানের ‘সন্ত্রাসের প্রাণকেন্দ্র’?
‘অপারেশন সিন্দুর’ আসলে শুধু একটি সামরিক পদক্ষেপ নয়, বরং ভারতের পক্ষ থেকে একটি কৌশলগত বার্তা—যা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে সেই অবকাঠামোয়, যা গত তিন দশক ধরে ভারতীয় ভূখণ্ডে রক্তপাত ঘটিয়ে এসেছে।