কলকাতা টাইমস নিউজ :
দেবজিৎ গাঙ্গুলী :
উত্তেজনা সীমান্তে, কিন্তু প্রস্তুতি শহরের অন্দরে… সেনার মতোই সতর্ক হচ্ছে লালবাজারের ‘ভ্যানগার্ড’ বাহিনী
কলকাতার রাজপথে সারাদিন যে শত শত সাদা টুপি আর প্রতিফলক ভেস্ট দেখা যায়, তারা কেবল যান নিয়ন্ত্রণেই ব্যস্ত নয়। এখন তারা শহরের সজাগ চোখও। আর আরেক প্রান্তে, ছাদে লাগানো অ্যান্টেনা আর নিরবিচারে ঘুরে বেড়ানো ভ্যানগুলি নিয়ত চালিয়ে যাচ্ছে শুনতে পাওয়ার কাজ। শুনছে ‘অদৃশ্য শব্দ’, যা হয়তো আগাম জানিয়ে দিতে পারে কোনও অশনিসংকেত।
লালবাজার এখন এক নতুন সমীকরণে ভাবছে: কলকাতা পুলিশের “চোখ” মানে ট্র্যাফিক বিভাগ, আর “কান” মানে ওয়্যারলেস ইউনিট। এবং এই দুই বিভাগের কাজকে গোয়েন্দা শাখার ইনপুটের সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি শহরের আকাশে যে ছয়টি রহস্যজনক ড্রোন দেখা গিয়েছে, সেই ঘটনার পর থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে চিন্তা শুরু করেছে লালবাজার। আর সেই ভাবনার অন্যতম স্তম্ভ হয়ে উঠেছে এই দুই বিভাগ।
এক পুলিশ কর্তা বলছেন, “আমরা এখন চাই ট্র্যাফিক আর ওয়্যারলেস মিলে শহরের ঘরে ঘরে না হোক, অন্তত প্রতিটি মোড়ে আগাম সতর্ক বার্তা দিতে পারে। বিপদের সিগন্যাল যদি রাস্তাতেই ধরা যায়, তাহলে বড় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব।”
মোবাইল ফোন আসার আগে পুলিশের যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল ভরসা ছিল ওয়্যারলেস সিগন্যাল। সেই ব্যবস্থার পরিকাঠামো ফের আধুনিকীকরণ হচ্ছে। সিম-যুক্ত ওয়্যারলেস সেট পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। এর ফলে দূরবর্তী ডিভিশনেও রিয়েল-টাইম তথ্য পৌঁছানো সহজ হবে।
বলা যায়, এখনকার এই ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, শুধু বার্তা আদান-প্রদানের জন্য নয়, বরং তথ্যপ্রাপ্তি, বিশ্লেষণ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়ার জন্য ব্যবহার করা হবে।
কলকাতা পুলিশের আওতায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভাঙড় ডিভিশন। বেহালা, যাদবপুর, পাটুলি, রিজেন্ট পার্কের মতো বিস্তৃত নতুন পুরসভার অঞ্চলগুলি আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে এখন কলকাতার শহরতলিগুলিও পুলিশের নজরদারির আওতায় এসেছে, আর সেই সঙ্গে বেড়েছে ট্র্যাফিক ও ওয়্যারলেস বিভাগের গুরুত্বও।
লালবাজার মনে করছে, ট্র্যাফিক বিভাগের কর্মীরা রোজ যা দেখেন, তা অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কারণ তাঁরা থাকেন সবার সামনে, কথা বলেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে, যানবাহনের চালক থেকে শুরু করে দোকানদার—সবার সঙ্গে। এই ‘লোকাল ইনপুট’ যদি সময়মতো ধরে নেওয়া যায়, তাহলে একাধিক বিপদ এড়ানো সম্ভব।
এক কর্তার কথায়, “এই কর্মীরা কেবল রুট ম্যানেজমেন্ট করেন না, ওঁরা শহরের স্পন্দন বোঝেন। তাঁদের ইনস্টিংক্ট অনেক সময় এক্সপ্লোসিভ হয়ে ওঠে, যদি তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়।”
কাশ্মীরের পহেলগামে পর্যটকদের উপর জঙ্গি হামলার পরে ভারতীয় সেনার ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পাল্টা পদক্ষেপ, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ঘোরতর টানাপড়েন—সব মিলিয়ে দেশ জুড়ে সতর্কবার্তা জারি রয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে বিশেষ করে সীমান্ত ঘেঁষা রাজ্যগুলিকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
যদিও কলকাতা সরাসরি সীমান্তবর্তী নয়, তবু তার অবস্থান পূর্ব ভারতে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার উপর চিনের রাডার থেকেও দূরে নয় এই শহর।
এই অবস্থায় ট্র্যাফিক আর ওয়্যারলেস—এই দুই বিভাগের কর্মীদের বলা হয়েছে: শুধু চোখ-কান খোলা রাখলেই চলবে না, দরকার হলে সেই চোখ দিয়ে সন্দেহ খুঁজে বার করতে হবে, আর সেই কান দিয়ে শুনতে হবে ইঙ্গিতহীন শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ।
ওয়্যারলেস প্রযুক্তির বিবর্তন: পুলিশের কান কীভাবে বদলাচ্ছে
সময়কাল | প্রযুক্তিগত পরিবর্তন | বৈশিষ্ট্য |
---|---|---|
১৯৮০-৯০ | অ্যানালগ ওয়্যারলেস | সীমিত দূরত্বে যোগাযোগ, হস্তচালিত নথিবদ্ধকরণ |
২০০০-এর দশক | ডিজিটাল ওয়্যারলেস | তুলনামূলক স্পষ্ট সিগন্যাল, ডিভিশনভিত্তিক সংযোগ |
বর্তমান | সিম-যুক্ত ওয়্যারলেস | ইন্টারনেট/মোবাইল নেটওয়ার্কে চলা সংযোগ, দ্রুত তথ্য আদানপ্রদান, GPS সংযুক্ত |
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা | AI ইন্টিগ্রেশন, অটোমেটেড অ্যালার্ট সিস্টেম | ইনপুটের ভিত্তিতে নিজেই বিপদ শনাক্ত করে সতর্কবার্তা পাঠাতে পারবে |
ট্র্যাফিক পুলিশের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: ‘যান নিয়ন্ত্রণ’ থেকে ‘ঝুঁকি শনাক্তকরণ’
✅ প্রতিটি বড় মোড়ে এখন ট্র্যাফিক কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে সন্দেহভাজন কার্যকলাপ শনাক্ত করার জন্য।
✅ বাহিনীকে “সিটিজেন ইন্টেলিজেন্স” পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে—যেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপচারিতাকে ইনফরমেশন সোর্স হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
✅ ট্র্যাফিক অফিসারদের দেওয়া হয়েছে QR স্ক্যানার, বডি ক্যামেরা ও GPS-যুক্ত রেডিও ডিভাইস।
✅ রুটিন নজরদারির সময় সন্দেহজনক ড্রোন, পার্কড গাড়ি, অথবা অচেনা ব্যাগ নজরে এলে সঙ্গে সঙ্গে ওয়্যারলেসে রিপোর্ট করার নির্দেশ রয়েছে।
কলকাতা পুলিশের নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনার রূপরেখা
১. প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি:
📡 আধুনিক সিম-যুক্ত ওয়্যারলেস সেট সব বিভাগের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ নিশ্চিত করবে।
🎥 শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও স্পর্শকাতর এলাকায় বাড়ানো হচ্ছে CCTV-র সংখ্যা ও নজরদারি ক্ষমতা।
🚨 সন্দেহভাজন গতিবিধি শনাক্ত হলে ইনপুট দ্রুত কন্ট্রোল রুমে পাঠানো বাধ্যতামূলক।
২. ফিল্ড ফোর্স রি-অরগানাইজেশন:
👮🏻♂️ ট্র্যাফিক ও ওয়্যারলেস বিভাগকে গোয়েন্দা ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত করে তথ্যের সমন্বয় সাধন।
🏍️ পেট্রলিং ইউনিটের সংখ্যা বাড়িয়ে অলিগলিতে টহলের সময়সূচি পরিবর্তন করা হচ্ছে।
৩. ড্রোন ও এয়ার স্পেস নজরদারি:
🛩️ সম্প্রতি দেখা গিয়েছিল কলকাতার আকাশে ড্রোন, যার উৎস এখনও অজানা।
🛰️ রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং সেন্ট্রাল এজেন্সিগুলির সঙ্গে সমন্বয়ে শুরু হয়েছে এয়ার ট্র্যাকিং।
৪. জনসচেতনতা ও সহযোগিতা:
📢 পুলিশ হেল্পলাইন নম্বর ও SOS অ্যাপ ব্যবহারে উৎসাহিত করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
🧍🏻 স্থানীয় নাগরিকদের কাছ থেকে ইনপুট সংগ্রহের জন্য ‘নাগরিক সহযোগিতা প্রোগ্রাম’ চালু।
যদিও লালবাজারে যুদ্ধের ময়দান নেই। কিন্তু প্রস্তুতি চলছে যুদ্ধের মতো। শুধু বন্দুক বা গুলি নয়—এখন কলকাতাকে রক্ষা করতে হলে দরকার একটা সজাগ, প্রযুক্তিনির্ভর, ফিল্ড-ফোকাসড বাহিনী। আর তার প্রথম সারিতে থাকবে যাঁরা ট্র্যাফিক সিগন্যাল সামলান আর যাঁরা রেডিওতে সতর্ক বার্তা ধরেন—ওঁরাই এখন শহরের আসল সেনা।