কলকাতা টাইমস নিউজ : প্রতিবেদন :
তিন দশক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সংকীর্ণ একটি সেতু। নীচে উত্তাল ইন্দ্রায়ণী নদী। প্রতিদিনের মতোই রবিবার ছিল ছুটির আমেজ, পর্যটকের ভিড় উপচে পড়েছে সেতুর উপর। হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল কাঠামো। মুহূর্তে জলস্রোতে তলিয়ে গেল বহু মানুষ। এখনও পর্যন্ত চারজনের মৃত্যু নিশ্চিত, আহত অন্তত ৫০। উদ্ধারকাজ চলেছে প্রায় ১৫ ঘণ্টা। আর এই ঘটনা ঘিরে উঠে এল দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক উদাসীনতার নির্মম দলিল।
পুণে জেলার তালেগাঁওয়ের কাছে অবস্থিত এই ৪৭০ ফুট দীর্ঘ সেতুটি ইন্দ্রায়ণী নদীর উপর নির্মিত হয়েছিল বহু বছর আগে। সেতুটির প্রস্থ মাত্র চার ফুট— যেখানে একসাথে একটি টু-হুইলার ও দু’জন পথচারী কষ্ট করে চলাচল করতে পারে। তবুও রবিবার দুপুরে সেতুর উপর একসঙ্গে ভিড় জমে প্রায় শতাধিক মানুষের। কেউ স্কুটার নিয়ে, কেউ হেঁটে, কেউ ছবি তুলতে এসে দাঁড়িয়েছিল পুরনো কাঠামোটির উপর। সেই চাপেই কেঁপে উঠল সেতু। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে কম্পন হচ্ছিল। তারপর আচমকা ভেঙে পড়ে সেটি। বহু মানুষ স্রোতে ভেসে যায়। কিছু মানুষ নদীর পাড়ে লেগে থাকা পাইপ ধরে প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সেতুটির অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই শোচনীয়। মরচে ধরা লোহা, ফাটা সিমেন্ট, জায়গায় জায়গায় গর্ত— বহুবারই পঞ্চায়েত এবং জনপথ দফতরকে জানানো হয়েছিল। ২০১৭ সালে প্রাক্তন বিধায়ক দিগম্বরদাদা ভেগড়ে রাজ্য সরকারকে নতুন সেতুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে চিঠি লেখেন। তাতে বলা হয়েছিল, “এই সেতু দিয়ে আট-দশটি গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, পড়ুয়ারা প্রতিদিন যাতায়াত করে।”
২০২৩ সালে রাজ্য সরকারের তরফে ₹৮০,০০০ বরাদ্দও করা হয় মেরামতির জন্য, বিজেপি বিধায়ক তথা মন্ত্রী রবিদ্র চবনের সুপারিশে। কিন্তু কাজ আর হয়নি। বরং স্থানীয়দের উদ্যোগেই জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট ব্লক বসিয়ে মেরামতির চেষ্টা করা হয়।
এই ঘটনার পর এক বেঁচে ফেরা যুবক, অমল জানান, “সেতু ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই চিৎকার করছিল। অনেকেই নদীতে পড়ে যায়। আমি একটা পাইপ ধরে কোনোরকমে উঠতে পারি।”
অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শীর অভিযোগ, “সেতুর উপর মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে সবাই ছবি তুলছিল। কেউই সতর্কতা বোর্ডের কথা মানেনি।”
প্রতিসপ্তাহান্তে ৮ হাজারের বেশি মানুষের যাতায়াত হয় এই এলাকায়। অথচ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনও স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। বহু অনুরোধের পর মাত্র একজন কনস্টেবলকে উইকএন্ডে মোতায়েন করা হয়। সেই পুলিশ রবিবার দুপুরে ভিড় সরালেও, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফের ফিরে আসে উৎসবমুখর জনতা।
ঘটনার পরে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ার জানান, “সেতুটি মরচে ধরা ছিল, সম্ভবত অতিরিক্ত ভিড়ের কারণেই ভেঙে পড়ে।” তবে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে— যদি তা-ই হয়, তবে এতদিন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন?
উল্লেখযোগ্যভাবে, এই ইস্যু একাধিকবার বিধানসভা ও সংসদেও উঠেছিল। তবু কিছুই হয়নি। তালেগাঁওয়ের এই বিপর্যয় কেবল একটি সেতুর ভাঙন নয়, এটি আমাদের প্রশাসনিক দায়হীনতার নগ্ন উদাহরণ। স্থানীয়দের বারবার সাবধানবাণী, জনপ্রতিনিধিদের আবেদন, অর্থ বরাদ্দ— সবই মিথ্যা হয়ে রইল কারণ একটাই: কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আজ ইন্দ্রায়ণীর স্রোতে প্রাণ হারালেন চারজন। কাল হয়তো অন্য কোথাও, অন্য এক কাঠামোর ধ্বংসস্তূপে আবার লেখা হবে নতুন একটি শোকগাথা— যদি না এখনই জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।