কলকাতা টাইমস নিউজ :নিজস্ব সংবাদদাতা : শিমলা :
যেখানে শহুরে সভ্যতা একাধিক বিয়েকে গোপনতা আর নিষেধের চাদরে ঢেকে রাখে, সেখানেই হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম শিল্লাই নতুন করে আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে এখানকার হট্টি সম্প্রদায়ের দুই ভাই— প্রদীপ এবং কপিল নেগি— একসঙ্গে বিয়ে করলেন সুনীতা চৌহান নামের এক মহিলাকে। তবে গোপনে নয়, সমাজের সামনে, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের উপস্থিতিতে তিন দিনের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
এই ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত বিয়ের গল্প নয়, বরং বহু প্রাচীন একটি রীতির পুনরুজ্জীবন— ‘জোড়িবিবাহ’ বা ‘দ্রৌপদী প্রথা’। যা এক সময় হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা জনজাতিগুলির সমাজবদ্ধ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
“এটা ছিল আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত”
জল শক্তি দপ্তরে কর্মরত বড় ভাই প্রদীপ বলেন, “বিশ্বাস, যত্ন আর দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার একটি রীতি এটা। আমরা কোনও লুকোচুরি করিনি, কারণ আমরা আমাদের শিকড় নিয়ে গর্বিত।”
ছোট ভাই কপিল, যিনি বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন এই বিয়ের জন্য, জানান, “আমরা বরাবর বিশ্বাস করেছি খোলামেলা ভালোবাসা ও স্থিতিশীল জীবনের উপরে। একত্রে থাকলে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়াও সহজ হয়।”
সুনীতা চৌহান, দুই ভাইয়ের স্ত্রী, স্পষ্টভাবেই বলেন, “এই সিদ্ধান্ত ছিল আমার নিজের। কেউ আমাকে জোর করেনি। আমরা একসঙ্গে এই পথ বেছে নিয়েছি, সম্মতিতে, শ্রদ্ধায়।”
স্থানীয় বাসিন্দা বিষাণ তোমার জানান, “আমাদের গ্রামে এখনও প্রায় তিন ডজন পরিবার আছে যেখানে দুই বা তিন ভাই মিলে এক স্ত্রীকে বিবাহ করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা গোপনে হয়। এই পরিবারটা সাহসিকতার সঙ্গে তা প্রকাশ করেছে, সম্মান দেখিয়েছে সংস্কৃতিকে।”
এই ধরনের বিবাহ প্রচলিত স্থানীয় নাম ‘জোড়িবিবাহ’ বা ‘দ্রৌপদী প্রথা’। অর্থনৈতিক বাস্তবতা এবং জমি ভাগাভাগির সমস্যা এড়াতে এই ধরনের বিবাহের প্রচলন হয়েছিল হিমাচলের সিরমাউরের ট্রান্স-গিরি অঞ্চলে। একসঙ্গে থাকা মানেই জমির টুকরো না হওয়া, পরিবার একত্রে থাকা এবং পাহাড়ি জমির সীমিত ব্যবহারের মধ্যে টিকে থাকা।
এই প্রথা এখনও হিমাচলের কিন্নর, লাহৌল-স্পিতি ছাড়াও উত্তরাখণ্ডের জউনসার-বাওয়ার অঞ্চলে বজায় রয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তোড়া উপজাতিতেও এক সময় এ প্রথার চল ছিল। এমনকি তিব্বত, নেপাল, আফ্রিকা ও পলিনেশিয়ার নানা জায়গায় ইতিহাসে পলিয়ান্দ্রির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যদিও বহু দেশে তা এখন নিষিদ্ধ।
সম্প্রতি তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পাওয়া হট্টি সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন রীতিগুলি শুধু বিবাহ নয়, বরং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। তবে সমাজে প্রজন্মের পার্থক্য প্রকট। প্রবীণরা যেখানে রীতিকে আঁকড়ে ধরেন, তরুণরা অনেক সময় ব্যক্তি স্বাধীনতা ও শহুরে জীবনের অভিজ্ঞতার দিকে ঝোঁকে।
কিন্তু শিল্লাইয়ের এই বিয়ে এক নতুন আলো ফেলেছে— যেখানে লজ্জা নেই, গোপনতা নেই, বরং আছে সংস্কৃতির গর্ব, ঐতিহ্যের সম্মান এবং মানবিক সম্পর্কের এক অনন্য উদাহরণ।
হিমাচলের পাহাড়ি জনজীবনে পলিয়ান্দ্রি নতুন কিছু নয়। তবে একে স্বাভাবিকতা এবং মর্যাদার সঙ্গে প্রকাশ্যে মেনে নেওয়া এক সাহসী পদক্ষেপ। এ যেন পাহাড়ের বুক থেকে উঠে আসা এক বার্তা— যে সংস্কৃতিকে এতদিন চুপিচুপি পালন করা হতো, আজ তা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায়, “হ্যাঁ, এটাই আমাদের রীতি। আর আমরা গর্বিত।”




