কলকাতা টাইমস নিউজ :নিজস্ব সংবাদদাতা :কলকাতা ,০৬ অক্টোবর :
২০২২ সালের সেই দুঃসহ স্মৃতি যেন আবার ফিরে এল কলকাতায়। ফের এক কিশোরীর মৃত্যুতে শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গির আতঙ্ক। পুজোর আনন্দের আবহের মধ্যেই সল্টলেকের বাসিন্দা রূপসী জানার অকাল মৃত্যু ফের তুলে আনল তিন বছর আগের দিৎসা গাঙ্গুলির মর্মান্তিক পরিণতির কথা।
রবিবার রাতে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় ১৫ বছর বয়সী রূপসীর। জানা গিয়েছে, বিধাননগর পৌরনিগমের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইএসআই হাউসিং কমপ্লেক্সে থাকত সে। তৃতীয়া থেকেই জ্বরে আক্রান্ত ছিল রূপসী। ২ অক্টোবর, অর্থাৎ দশমীর দিন অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টানা চিকিৎসার পরও শেষরক্ষা হয়নি। রবিবার তার শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হলে চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও প্রাণ ফেরাতে পারেননি।
রূপসীর বাবা জানালেন, “২৫ তারিখে মেয়ের জ্বর হয়। প্রথম পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি। সপ্তমী পর্যন্তও ঠিক ছিল। পরে আবার পরীক্ষা করালে ডেঙ্গি ধরা পড়ে। তখনই হাসপাতালে ভর্তি করি। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর শরীর ভেঙে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না।”
পরিবার সূত্রে আরও জানা গিয়েছে, রূপসীর দিদাও ষষ্ঠীর দিন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। একই পরিবারের দুই সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, “চারপাশে মশা ভয়ঙ্করভাবে বেড়েছে। পৌরসভার ফগিং নিয়মিত হচ্ছে না। আমরা এখন ভয়ে আছি।”
এই ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর, দুর্গাপুজোর পরেই ডেঙ্গিতে মৃত্যু হয়েছিল ১৩ বছরের দিৎসা গাঙ্গুলির। সেবারেও একই পরিবারের মা-মেয়ে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে বাগুইআটির এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। মা বেঁচে ফিরলেও, দিৎসাকে আর ফেরানো যায়নি। পরবর্তীতে পরিবার অভিযোগ করেছিল চিকিৎসায় গাফিলতির। বাগুইআটি থানায় নার্সিং হোম ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তিন বছর কেটে গেলেও সেই মামলা আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
দিৎসার বাবা-মা আজও ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তাঁদের কথায়, “সরকারি নীরবতা আরও যন্ত্রণা দেয়। প্রতিবারই নতুন মৃত্যু হয়, কিন্তু শিক্ষা নেওয়া হয় না।”
বিধাননগর পৌরনিগমের তরফে জানানো হয়েছে, আক্রান্ত এলাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে ফগিং ও লার্ভা নাশক ছিটানোর কাজ চলছে। নাগরিকদের সচেতন করতে মাইকিং, পাড়ায় সভা, ও পোস্টার প্রচার শুরু হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটি পরিবারকে সতর্ক করা হচ্ছে যাতে বাড়ির ছাদ, বারান্দা বা ফুলের টবে কোথাও জল জমে না থাকে।
পৌরনিগমের এক আধিকারিক জানান, “আমরা নিয়মিত পরিদর্শন করছি। ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নাগরিক সহযোগিতাই সবচেয়ে জরুরি।”
চিকিৎসকদের মতে, পুজোর সময় আবহাওয়া বদলের ফলে ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে। দিনে রোদ, রাতে হালকা বৃষ্টি— এমন পরিস্থিতিতে মশা বংশবৃদ্ধি করে দ্রুত। চিকিৎসকরা বলছেন, দীর্ঘজ্বর, শরীরে ব্যথা, চোখের পিছনে যন্ত্রণা বা লালচে দাগ দেখা দিলে দ্রুত পরীক্ষা করানো উচিত।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “২০২২ সালের মতো পরিস্থিতি এড়াতে এবারই সময় সজাগ হওয়ার। সরকারি প্রশাসন, পৌরসভা এবং নাগরিক— তিন পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগেই ডেঙ্গি মোকাবিলা সম্ভব।”
বারবার একই রকম মৃত্যু শহরের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। দিৎসা গাঙ্গুলির পরিবারের মতো রূপসী জানার পরিবারও এখন শোকের সঙ্গে ক্ষোভে ভুগছে। তাঁদের দাবি— “প্রশাসন ও চিকিৎসা পরিকাঠামো যদি আগেভাগে সক্রিয় হতো, এই মৃত্যু রোখা যেত।”
পুজো-পরবর্তী আনন্দের আবহে ফের এক তরুণ প্রাণের নিভে যাওয়া যেন সতর্কবার্তা— কলকাতার ঘরে ঘরে যেন আবার সেই ২০২২-এর আতঙ্ক ফিরে না আসে। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ, নাগরিকদের সচেতনতা ও চিকিৎসার প্রতি দায়বদ্ধতা— এই তিনের সমন্বয়েই হয়তো বাঁচানো যাবে আরও কত শত ‘রূপসী’ ও ‘দিৎসা’কে।




