কলকাতা টাইমস নিউজ :নিজস্ব সংবাদদাতা :কলকাতা ,০৭ অক্টোবর :
সুরের দুনিয়া থেকে এবার সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে পা রাখতে চলেছেন সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন ও জনপ্রিয় গায়িকা মৈথিলি ঠাকুর। গানে গানে কোটি মানুষের মন জয় করা এই তরুণী এবার ভোটে নামতে চলেছেন নিজের জন্মভূমির জন্য। সূত্রের খবর, আসন্ন বিহার বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন তিনি, এবং টিকিটও পেতে পারেন মধুবনি জেলার কোনও আসনে।
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অন্যতম পরিচিত গায়িকা হয়ে উঠেছেন মৈথিলি। তাঁর কণ্ঠে মিশে থাকে মৈথিলি, ভোজপুরি, হিন্দি ও শাস্ত্রীয় সংগীতের সুর। লোকগীতি থেকে ভজন— সবেতেই দক্ষ তিনি।
অল্প বয়সেই তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে একাধিকবার তাঁর প্রশংসা করেছেন।
২০২৪ সালের শুরুতে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন উপলক্ষে মৈথিলি গেয়েছিলেন ‘মা শবরী’— একটি ভজন যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে যায়। সেটি শেয়ার করে প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন,
“অযোধ্যায় রাম লালার প্রাণ প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত গোটা দেশের মানুষকে শ্রীরামের জীবন ও আদর্শের নানা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে একটি আবেগঘন ঘটনা শবরীর সঙ্গে যুক্ত। শুনুন, কী সুন্দর সুরে মৈথিলি ঠাকুরজি তা প্রকাশ করেছেন।”
এই প্রশংসাই যেন তাঁর জীবনযাত্রায় নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসার পর থেকেই মৈথিলিকে নিয়ে জল্পনা শুরু হয়— তিনি কি সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবেই থাকবেন, নাকি সক্রিয় রাজনীতিতেও নামবেন?
শেষমেশ সেই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হতে শুরু করে গত সপ্তাহে, যখন বিজেপির বিহার প্রভারি বিনোদ তাওড়ে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায়-এর সঙ্গে মৈথিলি ও তাঁর বাবার বৈঠকের ছবি ‘এক্স’-এ পোস্ট করেন।
তাওড়ে লিখেছিলেন,
“১৯৯৫ সালে লালুপ্রসাদ যাদব ক্ষমতায় আসার পর বিহার ছেড়ে চলে গিয়েছিল যে পরিবারগুলি, সেই পরিবারের কন্যা— বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মৈথিলি ঠাকুরজি এখন পরিবর্তিত বিহার দেখে ফিরতে চাইছেন।”
তাওড়ে আরও জানান, তাঁরা মৈথিলিকে বিহারের মানুষের জন্য অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
জবাবে মৈথিলিও লিখেছিলেন—
“যাঁরা বিহারের জন্য বড় স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের সঙ্গে প্রতিটি কথোপকথন আমাকে দৃষ্টি আর সেবার শক্তির কথা মনে করিয়ে দেয়। অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞ।”
এই বিনিময়ের পরই রাজনৈতিক মহলে জোরদার আলোচনা শুরু হয়— খুব শীঘ্রই মৈথিলি বিজেপিতে যোগ দিতে পারেন এবং মধুবনির টিকিট পেতে পারেন।
মৈথিলি ঠাকুর মিথিলা অঞ্চলের মেয়ে— যেখানে মধুবনি, দরভাঙা, সমষ্টিপুরের মতো জেলাগুলি পড়ে। তাঁর পরিবার বহু বছর আগে কাজের সূত্রে দিল্লিতে চলে যায়, কিন্তু মৈথিলির মধ্যে জন্মভূমির প্রতি টান কখনও কমেনি। তিনি প্রায়ই সাক্ষাৎকারে বলেন, “মৈথিলি সংস্কৃতি আমার শিকড়। আমি সবসময় এই মাটির গানে বাঁচি।”
এই আবেগই এবার তাঁকে রাজনীতিতে টেনে আনছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
সূত্রের খবর, বিজেপি তাঁকে মধুবনি বা দরভাঙা জেলার আলিগড় আসন— এই দুইয়ের মধ্যে একটিতে প্রার্থী করতে পারে। যদিও দলীয় সূত্রে এখনও কোনও সরকারিভাবে ঘোষণা হয়নি।
রাজনীতিতে নতুন মুখ এনে বিজেপি বিহারে এক ধরনের ‘সাংস্কৃতিক সংযোগ’-এর বার্তা দিতে চাইছে বলেই বিশ্লেষকদের মত।
বিহারের মিথিলা অঞ্চলে নারী ভোটার, তরুণ সমাজ এবং সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বিপুল।
একজন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও তরুণ ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে মৈথিলির উপস্থিতি ভোটে মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলতে পারে।
এছাড়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর জনপ্রিয়তা— কোটি ফলোয়ার— তাঁকে এমন এক ‘ডিজিটাল প্রভাবশালী মুখ’ বানিয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।
বিহার বিধানসভা নির্বাচনের তফসিল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন— আগামী ৬ ও ১১ নভেম্বর দুই দফায় ভোট হবে, আর গণনা হবে ১৪ নভেম্বর।
এই সময়েই এমন বৈঠক ও ছবি প্রকাশ বিজেপির কৌশলেরই ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজ্যে নীতীশ কুমার নেতৃত্বাধীন জেডিইউ-বিজেপি জোট যেখানে সরকারবিরোধী মনোভাবের মুখোমুখি, সেখানে জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক মুখকে সামনে আনা ভোটে ‘ইমোশনাল কানেক্ট’ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
যদিও সরকারিভাবে মৈথিলি নিজে এখনই প্রার্থিতা নিয়ে কিছু ঘোষণা করেননি। তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
“বিহারে গিয়েছিলাম, বিনোদ তাওড়ে ও নিত্যানন্দ রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। টিভিতে এমন খবর দেখছি, কিন্তু এবিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি সুযোগ পাই, নিজের গ্রামের হয়ে লড়ব। কারণ জন্মভিটের প্রতি টান আলাদা।”
এই বক্তব্যই তাঁর ইচ্ছার গভীরতা বোঝায়— তিনি রাজনীতিতে নামছেন স্রেফ দলীয় পরিকল্পনায় নয়, বরং নিজের মাটির প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে।
মৈথিলির প্রভাব শুধু সংগীতেই নয়, তিনি আজ ভারতের নতুন প্রজন্মের সাংস্কৃতিক মুখ।
২০২৪ সালে আয়োজিত প্রথম সরকারি ‘ন্যাশনাল ক্রিয়েটর অ্যাওয়ার্ডস’-এ তাঁকে সম্মানিত করা হয়েছিল ‘কালচারাল অ্যাম্বাসাডর অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারে। উদ্দেশ্য ছিল— ‘আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভর নতুন ভারতের গল্প যাঁরা বলছেন, তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়া।’
এই স্বীকৃতিই যেন তাঁকে সংস্কৃতি থেকে সমাজসেবায়, সমাজসেবা থেকে রাজনীতিতে নিয়ে আসার স্বাভাবিক ধাপ তৈরি করেছে।
ভারতীয় রাজনীতিতে বিনোদন বা সংস্কৃতি জগতের মানুষদের প্রবেশ নতুন কিছু নয়। কিন্তু মৈথিলির বিষয়টি ভিন্ন— তিনি চলচ্চিত্র তারকা নন, বরং মাটির গান গাওয়া এক শিল্পী, যিনি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নিজের শ্রোতাদের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
তাই অনেকেই মনে করছেন, যদি তিনি সত্যিই মধুবনি থেকে প্রার্থী হন, তবে সেটি কেবল রাজনৈতিক ঘটনাই নয়— বরং সংস্কৃতি ও রাজনীতির এক নতুন সেতুবন্ধনের প্রতীক হয়ে উঠবে।
আজকের ডিজিটাল যুগে যেখানে জনপ্রিয়তা আর রাজনীতি ক্রমশ মিশে যাচ্ছে, সেখানে মৈথিলি ঠাকুরের ভোটমুখী যাত্রা এক নতুন অধ্যায় খুলে দিতে পারে।
একদিকে তিনি দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রেরণা, অন্যদিকে মাটির সংস্কৃতির প্রতিনিধি।
গানের মতোই কি রাজনীতিতেও ছন্দ মিলবে তাঁর জীবনে?
বিহারবাসী এখন সেই উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায়।




