কলকাতা টাইমস নিউজ :নিজস্ব সংবাদদাতা :কলকাতা ,১৩ অক্টোবর :
ছয় বছর আগে যেই মামলায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গন কেঁপে উঠেছিল, সেই রাজীব কুমার বনাম সিবিআই মামলা আজ, সোমবার, ফের উঠছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। কলকাতা হাই কোর্ট রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারকে যে আগাম জামিন দিয়েছিল, সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করেই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিল সিবিআই। দীর্ঘ ছয় বছর পর আজ সেই মামলার শুনানি হবে প্রধান বিচারপতি ডি.ওয়াই. চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি কে. বিনোদ চন্দ্রনের বেঞ্চে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবারের শুনানির তালিকায় মামলাটি রয়েছে এক নম্বরে। এর ফলে ফের মুখোমুখি হতে চলেছেন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী পুলিশ আধিকারিক রাজীব কুমার এবং কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
২০১৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতা হাই কোর্ট রাজীব কুমারকে আগাম জামিন দেয়। রাজীব তখন বিধাননগরের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার এবং রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক মুখ। মাত্র তিন দিনের মধ্যে— ৪ অক্টোবর— হাই কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায় সিবিআই।
তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২৫ ও ২৯ নভেম্বর মামলাটি শুনেছিল শীর্ষ আদালত। ২৯ নভেম্বরের দিনই রাজীবকে নোটিস জারি করা হয় এবং ২০ ডিসেম্বর সেই নোটিস হাতে পান রাজীব কুমার। এরপর বছর ঘুরে বছর গেলেও মামলার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ছ’বছরের মধ্যে এই মামলাটি মাত্র দু’বার আদালতে ওঠে শুনানির জন্য।
মামলার মূল সূত্র সারদা চিটফান্ড কাণ্ড। প্রথমে এই চাঞ্চল্যকর প্রতারণা মামলার তদন্ত করছিল রাজ্য সরকারের গঠিত বিশেষ তদন্তকারী দল (SIT)। সেই সিটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন রাজীব কুমার।
২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট সারদা মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেয়। এরপর থেকেই দুই সংস্থার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। সিবিআই অভিযোগ তোলে, রাজীব তদন্তে সহযোগিতা করছেন না, গুরুত্বপূর্ণ নথি গোপন ও বিকৃত করেছেন— যাতে প্রমাণ নষ্ট হয়ে যায়।
অন্যদিকে রাজীব কুমার দাবি করেন, তিনি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন— এমনকি শিলংয়ে পাঁচ দিন ধরে প্রায় ৪০ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদেও অংশ নিয়েছেন। পরবর্তীতে কলকাতাতেও হাজিরা দিয়েছেন সিবিআই অফিসে। তবুও সিবিআই তাঁকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট রাজীবকে অন্তর্বর্তী রক্ষাকবচ দেয়। কিন্তু একই বছরের মে মাসে আদালত সেই রক্ষাকবচ প্রত্যাহার করে জানায়, রাজীব চাইলে আগাম জামিনের আবেদন করতে পারেন।
এরপর রাজীব কলকাতা হাই কোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেন। সিবিআই দাবি করে, রাজীব প্রভাবশালী ব্যক্তি, তাঁর জামিন হলে তদন্ত ব্যাহত হবে এবং সাক্ষ্য প্রমাণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
রাজীবের পক্ষ থেকে পাল্টা যুক্তি দেওয়া হয়, তিনি তদন্তে বারবার সহযোগিতা করেছেন, তাই হেফাজতে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আদালত তাঁর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
হাই কোর্টের বিচারপতি শহিদুল্লাহ মুন্সি ও শুভাশিস দাশগুপ্তের বেঞ্চ রাজীব কুমারের আগাম জামিনের আবেদন মঞ্জুর করে। আদালত রায়ে বলে, রাজীবকে বহুবার জেরা করা হয়েছে, কোনও নতুন বা চাঞ্চল্যকর প্রমাণ মেলেনি— ফলে হেফাজতের প্রয়োজন নেই।
তবে শর্তসাপেক্ষে জামিন মঞ্জুর করা হয়—
-
সিবিআইয়ের ডাকা মাত্র হাজিরা দিতে হবে, তবে ৪৮ ঘণ্টা আগে নোটিস দিতে হবে।
-
তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে।
-
কোনও শর্ত ভঙ্গ হলে সিবিআই জামিন বাতিলের আবেদন জানাতে পারবে।
এই রায়ের বিরুদ্ধেই সিবিআই সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, যার শুনানি আজ হতে চলেছে।
রাজীব কুমারের নাম একসময় পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অন্যতম ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল’ নাম হয়ে উঠেছিল। সারদা মামলার তদন্ত ঘিরে তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের পদক্ষেপ রাজ্য-কেন্দ্র সংঘাতকে নতুন মাত্রা দেয়।
সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে নবান্ন থেকে ধর্না মঞ্চে নেমেছিলেন রাজীবের পক্ষে, যা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত। ফলে আজকের শুনানি শুধুমাত্র একটি আইনি মামলা নয়, প্রশাসনিক মর্যাদা ও রাজ্য-কেন্দ্র সম্পর্কেরও এক সূক্ষ্ম প্রতিফলন।
ছ’বছর পর ফের শুরু হতে চলেছে রাজীব কুমার ও সিবিআইয়ের সেই বহুলচর্চিত লড়াই। এখন নজর সবার, সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ কী রায় দেয়— হাই কোর্টের আগাম জামিন বহাল থাকে, না কি ফের তদন্তের নতুন অধ্যায় খুলে যায় ?




