কলকাতা টাইমস নিউজ :নিজস্ব সংবাদদাতা :কলকাতা : ১৪ অক্টোবর :
পুজোর পরেই ফের ছড়িয়ে পড়ছে মশাবাহিত রোগ, ২০২৫ সালে ডেঙ্গি আক্রান্ত ৭৯১, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত তিন হাজারেরও বেশি !
পুজোর আনন্দ শেষ হতেই ফের শহর জুড়ে চিন্তা— মশার দাপটে দিশেহারা কলকাতা। দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলের বাঁশের খোলা মুখ, জমে থাকা বৃষ্টির জল, এবং আলোকসজ্জার তারে ভেজা গর্ত— এসবই এখন যেন ডেঙ্গি মশার নতুন ‘ফুর্তির জায়গা’।
অক্টোবর-নভেম্বর— ঠিক এই সময়েই প্রতিবছর কলকাতায় ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে। তাই বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা, এখনই ব্যবস্থা না নিলে শহরজুড়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
কলকাতা পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কলকাতায় ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭৯১ জন। গত বছর একই সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৮৯। অর্থাৎ, এক বছরে আক্রান্তের হার প্রায় ৩৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পুরসভার নির্দেশ অনুযায়ী, পুজো উদ্যোক্তাদের প্যান্ডেল খোলার সময়সীমা দেওয়া হয়েছে দুই সপ্তাহ। কিন্তু সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই হাজির কালীপুজো। ফলে ফের জমা জল ও বাঁশের গর্তে মশার প্রজননের আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
পুরসভার এক শীর্ষ আধিকারিকের কথায়,
“আমরা বারবার সতর্ক করছি, নির্দেশিকা পাঠাচ্ছি, কিন্তু অনেক পুজো কমিটিই তা মানছে না। দুর্গাপুজোর পরই প্যান্ডেলগুলোর খোলা মুখে জমে থাকা জল মশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে।”
পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ অবশ্য দাবি করেছেন, প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্ক।
“প্রত্যেকটি পুজো কমিটিকে জানানো হয়েছে— বাঁশ খুলে দিতে হবে, গর্ত বুজিয়ে দিতে হবে। কালীপুজোর আগে কড়া নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে,” জানিয়েছেন অতীনবাবু।
ডেঙ্গির পাশাপাশি শহরে বাড়ছে ম্যালেরিয়ার প্রকোপও। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ১,১৫৬ জন, কিন্তু মাত্র দুই মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩,০৭৪ জনে।
এর মধ্যে শেষ চার সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছেন অন্তত এক হাজার মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ম্যালেরিয়ার হঠাৎ বৃদ্ধি তিনটি কারণে—
১️ আবহাওয়ার অস্বাভাবিক তারতম্য,
২️ নাগরিকদের অসচেতনতা,
৩️ এবং পুজোর সময়ে নির্দেশিকা অমান্য করে জল জমিয়ে রাখা।
একজন পতঙ্গবিদ বলেন,
“কলকাতার আর্দ্রতা এখন সারাবছরই বেশি। ফলে ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি— দু’টোই সারা বছর সক্রিয় থাকছে। তাই নজরদারি ও সচেতনতা দুটোই বাড়ানো দরকার।”
পুরসভার মুখ্য পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাসের মতে,
“ম্যালেরিয়ার স্ত্রী অ্যানোফেলিস মশা সাধারণত রাত ১০টা থেকে ভোর ৪টার মধ্যে কামড়ায়। ছাদের গর্ত, নির্মীয়মাণ বাড়ি, খোলা ড্রেন বা বৃষ্টির জল জমা জায়গাই এদের প্রজননক্ষেত্র। তাই বিশেষ রাসায়নিক স্প্রে এবং ক্লোরিনযুক্ত জলে নজর বাড়ানো হয়েছে।”
যদিও গত বছর কলকাতার ৬৯টি ওয়ার্ডকে ‘অতি ম্যালেরিয়া প্রবণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ বছর ১১টি ওয়ার্ডকে রাখা হয়েছে ‘স্পর্শকাতর’ তালিকায়।
উত্তর ও মধ্য কলকাতায় আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। পুরসভার মতে, নির্মীয়মাণ আবাসনে অভিযান চালিয়ে তিনটি প্রকল্পে জমা জলের সন্ধান মিলেছে।
তবে শহরবাসীর একাংশের অভিযোগ,
“পুরসভার নজরদারি যথেষ্ট নয়। পুজোর সময় বা বৃষ্টির পরে দল পাঠিয়ে স্প্রে করা হলে হয়তো পরিস্থিতি এত খারাপ হতো না।”
প্রশাসনের তরফে অবশ্য দাবি, ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া মোকাবিলায় কর্মী মোতায়েন ও প্রচার অভিযান চলছে।
কিন্তু বাস্তব বলছে—
মশার কামড় আজ কলকাতায় প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। সতর্কতা যতটা দরকার, তার অর্ধেকও এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
সংক্ষেপে পরিসংখ্যান:
-
ডেঙ্গি আক্রান্ত (১ জানুয়ারি–৫ অক্টোবর ২০২৫): ৭৯১ জন
-
ডেঙ্গি আক্রান্ত (গত বছর একই সময়ে): ৫৮৯ জন
-
ম্যালেরিয়া আক্রান্ত (১ জানুয়ারি–১০ অগস্ট): ১,১৫৬ জন
-
ম্যালেরিয়া আক্রান্ত (১০ অগস্ট–৫ অক্টোবর): ৩,০৭৪ জন
-
শেষ চার সপ্তাহে আক্রান্ত: অন্তত ১,০০০ জন
পুজোর উচ্ছ্বাস কাটতেই কলকাতার আকাশে এখন ঘনাচ্ছে মশাবাহিত রোগের কালো মেঘ।
পুরসভার কাগুজে সতর্কতা বাস্তবে রূপ না নিলে,
‘আনন্দের শহর’ হয়তো আবার পরিণত হবে ‘মশার আতঙ্কের শহরে’।




