কলকাতা টাইমস নিউজ :
দেবজিৎ গাঙ্গুলী :
তিব্বতের ইয়ারলুং ত্স্যাংপো নদীতে পৃথিবীর বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছে চীন। এই ড্যামটি পূর্ণ ক্ষমতায় চালু হলে এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র। তবে এই প্রকল্প ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে ভারত ও বাংলাদেশে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই ড্যাম থেকে শুকনো মৌসুমে জলের প্রবাহ কমে যাবে, আর বর্ষায় হঠাৎ জলের ঢলে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ বন্যা—দুই পরিস্থিতিই কোটি কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করবে।
ইয়ারলুং ত্স্যাংপো নদীটি তিব্বতের হিমবাহ অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নামে। এই নদী অববাহিকায় দীর্ঘকাল ধরেই বসবাস করে আসছে কোটি কোটি মানুষ। এমন একটি আন্তর্জাতিক নদীতে চীনের unilateral প্রকল্প আন্তর্জাতিক আইন ও কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে এটি স্থানীয় বাসিন্দাদের উচ্ছেদ ঘটাবে, অন্যদিকে নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ ও পরিবেশতন্ত্রের উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিচের দিকে থাকা দেশগুলোর ওপর—বিশেষত ভারত ও বাংলাদেশের কৃষি, জলসম্পদ ও জীবনযাত্রায়।
অপরদিকে হিমালয় অঞ্চল, যেখানে ভারত ও ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেট একত্রে সংঘর্ষ করছে, ভূমিকম্প, ধস ও হঠাৎ বন্যার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই এত বিশাল একটি ড্যাম নির্মাণ আরও দুর্যোগ ডেকে আনতে পারে বলে সতর্ক করছেন ভূতত্ত্ববিদরা।
যেমন ব্রহ্মপুত্র নদ বিশ্বের অন্যতম পলিসমৃদ্ধ নদী। এই পলি বাংলাদেশের উপকূলে ও ভারতীয় অংশে উর্বর ডেল্টা তৈরি করে। ড্যাম নির্মাণের ফলে এই পলি উজানে আটকে গেলে ডেল্টার উর্বরতা হ্রাস পাবে, যা খাদ্য নিরাপত্তায় সরাসরি প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে, সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন—যা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য—তীব্র ক্ষতির মুখে পড়বে। উপকূলীয় ক্ষয় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই অঞ্চলে জলবায়ু উদ্বাস্তু তৈরি করতে পারে।আবার ব্রহ্মপুত্র নদ একটি আন্তঃদেশীয় নদী হলেও, এখনো পর্যন্ত চীন-ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে কোনো পূর্ণাঙ্গ চুক্তি হয়নি এই নদীর জলবণ্টন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে। ফলে কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই চীন নদীতে হস্তক্ষেপ করতে পারছে। যেখানে ইউরোপে দানিয়ুব নদী নিয়ে ১৪টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি সুস্পষ্ট চুক্তিতে আবদ্ধ, সেখানে ব্রহ্মপুত্রসহ দক্ষিণ গোলার্ধের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নদী আজও গবেষণা ও শাসন কাঠামোর দারুণ ঘাটতিতে ভুগছে।
পসাপসী এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২৮৬টি আন্তঃদেশীয় নদী অববাহিকায় ৪,৭১৩টি গবেষণা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে বৈশ্বিক দক্ষিণের নদীগুলোর গবেষণা ও তথ্য ভয়াবহভাবে অনুপস্থিত। দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্দাস বা মেকং নদীর মতো বড় নদীগুলির ওপর কিছু গবেষণা হলেও ছোট ও মাঝারি নদীগুলি প্রায় উপেক্ষিত।
ফলে এই ধরনের মেগা প্রকল্পে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত না হলে শুধু একক দেশের উন্নয়ন নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য তা পরিণত হতে পারে এক ভয়াবহ পরিবেশগত ও মানবিক সংকটে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নদীগুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনায় গবেষণা, সংলাপ ও আন্তঃদেশীয় ঐক্যমতের কোনো বিকল্প নেই।